পথিকৃৎ শাহ্‌ আব্দুল করিম

 

শেখ ইমতিয়াজ মেহেদী হাসান : ‘সখি,কুঞ্জ সাজাও গো’-কিন্তু কার জন্য এ কুঞ্জ সাজাবো? আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির সমস্যার প্রেক্ষাপট নিজের সুর দ্বারা বদলানোর সেই মহান আদর্শে আদর্শিত পথিকৃৎ তথা প্রবাদ পুরুষ বাংলাদেশের বাউল শিল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা, বিখ্যাত বাউল সম্রাট শাহ্‌ আব্দুল করিম অসংখ্য অপূর্ণতা আর অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়ে ঢংকা বাজিয়ে গেছেন একটি সৃজনশীল বাংলাদেশ গড়ার। তাই একটি স্বাধীন ও স্বার্বভৌম দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এ সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে কি? আসুন দেশের সমস্যা বদলানোর প্রেক্ষাপটে আজ এক কাতারে সামিল হই,বদলে দেই সমস্যার ক্যানভাস।

আইসিইউ-তে লাইফ সাপোর্ট এলিমেন্ট দিয়ে রাখা অবস্থায় সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের কৃতি তথা শ্রেষ্ঠ সন্তান,বাংলার সমস্যার প্রেক্ষাপট বদলাতে অক্লান্ত শ্রম আর মেধা দিয়ে জন্ম দেয়া প্রায় দেড় হাজার গানের সৃষ্টিকর্তা, জীবদ্দশায় একুশে পদক, মেরিল-প্রথম আলো সম্মাননা পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত বাউল শিল্পের প্রবাদ পুরুষ শাহ্‌ আব্দুল করিম বিগত ২০১০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর’০৯ সকাল ৭:৫৮ মিনিটে আমাদেরকে অসীম শূন্যতা আর শোকের মহাসাগরে ভাসিয়ে সিলেটের নূরজাহান হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

Shah Abdul Karim

সৃজনশীল অসাম্প্রাদয়িক বাংলা গড়ার পথিকৃৎ শাহ্‌ আব্দুল করিম

তিনি চলে গেছেন এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য। কিন্তু একথাও ওই ধ্রুব আকাশের মত সত্য যে, তার মৃত্যু মানেই বাংলার সমস্যার প্রেক্ষাপট বদলাতে অসংখ্য সহযোদ্ধার জন্ম নেওয়া। আর এ’সকল সহযোদ্ধা তাদের পথিকৃৎ তথা প্রবাদ পুরুষের আদর্শে দীক্ষিত হয়ে উদাত্ত স্লোগান আর মুক্তির বিজয় মিছিল নিয়ে পদচারনা করবে বাংলার স্নেহ-ধুলিমাখা কর্দমাক্ত রাজপথে। তাই নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের হৃদয়ের মধ্যমণি হয়ে আছে,তাই না?সংস্কৃতি অঙ্গনের পবিত্র নেশায় আসক্ত বাউল সম্রাট জীবদ্দশায় তার নিজ গ্রামের নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র ৮ দিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন।তারপর যা শিখেছেন নিজের চেষ্টায় আর সেটাই তার সব থেকে বড় অর্জন যা আমাদের সকলেরই দৃশ্যমান।

দারিদ্রের মধ্যেই কঠোর প্ররিশ্রমের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেন শাহ্‌ আব্দুল করিম। শৈশব থেকেই একতারা ছিল তার নিত্যসঙ্গি। সঙ্গীতের প্রতি তিনি এতটাই অনুরাগী ছিলেন যে তা ছেড়ে চাকরিতে জড়াননি তিনি। ফলে কাটেনি তার দরিদ্র্য এবং বাধ্য হয়ে নিয়জিত ছিলেন কৃষিশ্রমে। জীবন কেটেছে সাদাসিদে ভাবে। তবে কোন কিছুই তার সঙ্গীতপ্রেম ঠেকাতে পারেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাউল ও আধ্যাত্নিক গানের তালিম নিতে থাকেন কমর উদ্দিন, সাধক রসিদ উদ্দিন, শাহ্‌ ইব্রাহিম মোস্তান বকস এর কাছ থেকে। দীর্ঘ এ সঙ্গীত জীবনে বাউল ও আধ্যাত্নিক গানের পাশাপাশি ভাটিয়ালি গানের ও বিচরণ ছিল তার। লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন ১৬শ’র বেশি গান। যেগুলো ছয়টি বইয়ে গ্রন্থিত আছে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আরও রয়েছে 

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান…….

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’,

’ বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’,

‘বসন্ত বাতাসে সইগো’,

‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’ ইত্যাদি।

 

বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তার ১০ টি গান ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে। লালন শাহ্‌, পাঞ্জু শাহ্‌ ও দুদ্দু শাহ্‌ এর দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিলেন আব্দুল করিম।

বাংলার বাউল শিল্পের একচ্ছত্র অধিপতি তথা অগ্রদূত শাহ্‌ আব্দুল করিমের ২০০৪ সালে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। ক্রমেই নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কখনও হাসপাতালে আবার কখনও বাড়ীতে দিন কাটান তিনি। শিল্পীর ইচ্ছানুযায়ী এ বছরের প্রথম দিকে মান্যবর সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল সম্রাট শাহ্‌ আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

২০০০ সালে তিনি কথাসাহিত্যিক আবদুর রউফ পদক পান। এছাড়া দ্বিতীয় সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননায় অধিষ্ঠিত হন শাহ্‌ আবদুল করিম। উল্ল্লেখযোগ্য অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে : লেবাক অ্যাওয়ার্ড ২০০৩, সিলেট সিটি কর্পোরেশন সম্মাননা ২০০৬, অভিমত সম্মাননা ২০০৬, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০০৪, আইডিয়া সংবর্ধনা স্মারক ২০০২ ও রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পদক ২০০০।

শুধু লেখনীর তুলিতে কি সকল ভক্ত আর শুভানুধ্যায়ীদের হৃদয় গহীনে শোকের মাতম তুলে চিরবিদায় নেয়া সকল শিল্পীর পিতৃতুল্য সেই গুরু,ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাউল সম্রাট,গুনীজন শাহ্‌ আব্দুল করিমের গুণকীর্তন ফুটিয়ে তোলা যায়? মায়ের বুকে সন্তান নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঘুমিয়ে নিজে স্বস্তিবোধ করে আর গর্ভধারিনী মা হয় ধন্য,অপরপক্ষে উর্বরা বাংলা এমনই একজনকে চিরজীবনের জন্য আশ্রয় দিয়ে স্বস্তি,শান্তি আর নিজেকে গর্বিতের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে সে হল আর কেউ নয়…..আমাদের সকলের অতিপ্রিয় মুখ বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমকে। তাই আসুন আজ বাউল সম্রাট শাহ্‌ আব্দুল করিমের আদর্শকে পুঁজি করে দেশের সমস্যার প্রেক্ষাপট বদলানোর শপথ নিয়ে একসুরে গেয়ে উঠি…..

জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে? যে ডরে,ভীরু সে মূঢ়,শত ধিক তারে।