ভাটির পুরুষ – ফার্স্ট টেক >> লিখেছেন শাকুর মজিদ

ভাটির পুরুষ শাহ আব্দুল করিম

 

২১ সেপ্টেম্বর, ২০০৩। সকাল ৯টায় সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে নেমেই পেয়ে যাই উজ্জ্বল দাশকে। এই উজ্জ্বল ও সুদীপ চক্রবর্তী দুই বন্ধু। উজ্জ্বল পড়ত জগন্নাথ কলেজে, সুদীপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ‘লন্ডনী কইন্যা’ নামে একটা নাটক লিখে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। সিলেটবাসীর একাংশ আমার বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করে একসময় আমাকে সিলেটে অবাঞ্ছিতই ঘোষণা করে। এ সময় হঠাৎ একদিন ফোন পাই ওয়েছ চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি সিলেট বিভাগ আন্দোলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। ফোনে আমাকে জরুরি তলব করে পুরানা পল্টনে তাঁদের অফিসে যেতে বলেন। আমি যথাসময়ে গিয়ে দেখি উজ্জ্বল ও সুদীপ- দুই বন্ধু মিলে আরেকটা মিটিং করে ফেলেছেন। ঢাকায় পড়াশোনা করা বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেটি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এ কমিটি। তারা ‘লন্ডনী কইন্যা’ নাটকের পক্ষ নিয়ে প্রেসক্লাবে সভা-সমিতি করতে চায়, আমার অনুমতি প্রয়োজন।

‘লন্ডনী কইন্যা’র প্রসঙ্গ থাক। আবদুল করিমের গল্প বলি।
উজ্জ্বল দাস মাঝেমধ্যে আমার লালমাটিয়ার অফিসে আসে। আমার একটা নতুন ক্যামেরা হয়েছে, ক্যানন এক্সএলএস। ক্যামেরায় কেমন করে ভালো ছবি ওঠে, আমি তা শিখতে শুরু করেছি মাত্র। আবদুল করিমের কথা উজ্জ্বলই আমাকে শোনায় এবং আমার জন্য একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে সে যথারীতি বিমানবন্দরে এসে হাজিরও হয়। গাড়িতে বসেই আমি ক্যামেরা অন করি। সিলেট অঞ্চলকে বোঝাতে হলে হাওরের সঙ্গে চা বাগানেরও দরকার আছে।

ভাটির পুরুষ

ভাটির পুরুষ

আমাদের ক্যামেরা রোল হতে থাকে।
সিলেট থেকে পশ্চিম দিকে ৭৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাঁ পাশে একটা বাঁক পাওয়া যায়। সেখান থেকে আরো ২৪ কিলোমিটার পথ বাঁ দিকে গেলে দিরাই উপজেলা সদর, আর সোজা ৩৬ কিলোমিটার গেলে হাছন রাজার শহর সুনামগঞ্জ। হাছন রাজা মরে গেছেন অনেক আগে, তাঁর জন্য আমাদের তাড়াহুড়া নেই। যেকোনো একবার তাঁর বাড়ি গিয়ে পরিত্যক্ত ঘরদরজা দেখে এলেই হয়। আমরা বাঁ দিকে মোড় নিই। আমাদের গাড়িতে বাজছে রণেশ ঠাকুরের গাওয়া আবদুল করিমের গান। এই অডিও ক্যাসেটটি কিছুক্ষণ আগে পথের পাশের এক বাজার থেকে কিনেছি আমরা। গাড়ির মধ্যে আবদুল করিমের গান, আর ডানে-বাঁয়ে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর, পালতোলা নৌকা, জাল ফেলে স্থির বসে থাকা মাঝি, অনেক দূরে ছোট ছোট নৌকা, ধীরগতির নৌকার চলাচল, এসব দেখতে দেখতে একসময় আমরা দিরাই বাজারে এসে পৌঁছি।

দিরাই উপজেলা শহরটিতে এই আমার প্রথম আসা।
আপাতভাবে এটিকে বেশ দরিদ্র বলেই মনে হলো। এক পাশে একটা নদী বয়ে গেছে। নদীতে অনেক নৌকা বাঁধা। সোয়ারি নৌকা। ঘুণ্টি দেওয়া। এসব নৌকার চল একসময় আমাদের এলাকায়ও [বিয়ানীবাজার] ছিল, আমার ছোটবেলায় দেখেছি। এখন এগুলো বিলীন হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট হয়েছে, গাড়ি চলে। নৌকার চল নেই; কিন্তু এখানে এটা রয়ে গেছে।

উজ্জ্বল এর আগে দিরাই এসেছে। পথঘাট তার মুখস্থ। আমাকে বলল, এখান থেকে উজানধল, করিম সাহেবের বাড়ি যাওয়ার একমাত্র পথ- এ হাওরের ওপর দিয়ে নৌকা বেয়ে যাওয়া। এক থেকে সোয়া ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। আমাদের দিনচুক্তিতে নৌকা নিতে হবে। ফেরার পথে নৌকা পাওয়া যাবে না। উজ্জ্বল চলে গেল নৌকার খোঁজে। আমাকে একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে সে চলে গেল। ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে এখানে আসবে সে। এর ফাঁকে আমাদের দুপুরের খাবার কিনবে- কিছু কলা, বিস্কুট, বনরুটি ও পানি।

আমি ক্যামেরা নিয়ে রাস্তার পাশে একটা দোকানের সামনে বসে থাকি। ভুসিমালের দোকান। পাশে একটি হিন্দু মন্দির, এর কাছেই মসজিদ। মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে আসছে। জায়গাটি তাহলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এলাকা? নিশ্চয়ই। তা না হলে এমন নির্বিঘ্নে এ দুই উপাসনালয়ের এত সহাবস্থান কেন হবে? এ বাজারে প্যান্ট পরা লোকজন খুব একটা দেখলাম না। প্যান্ট-শার্ট পরা লোকজন দেখলেই দেখি দিরাইয়ের লোকজন জিজ্ঞেস করে, ‘আফনারা কিতা ফির ছাবর বাড়ি যাইতানি?’
জি আয়।

স্থানীয় লোকজন ডাকেন পীর সাহেব। বাহ!
করিম সাহেবকে নিয়ে কত কথা বাজারে চালু। তিনি নাকি হিন্দু মহিলা বিয়ে করেছেন, তাঁর স্ত্রীর কবর আছে তাঁর চৌকির নিচে, হিন্দু মহিলা বিয়ে করার কারণে তাঁকে গ্রামছাড়া করা হয়, তাঁর স্ত্রীর জানাজা পড়ানো হয়নি- এমন অনেক কিছু। আমি উজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করি। সে কোনোটার জবাব জানে, কোনোটার নয়। আমাদের যাত্রা শুরু হয় কালনী নদী দিয়ে। কালনী নদী কখন এসে বরাম হাওরে মিশে গেছে টের পাওয়া গেল না। ভরা বর্ষায় নদী, হাওর, মিলেমিশে একাকার। দূরে পালতোলা কিছু নৌকা দেখা যায়। এমন লাল-নীল পালতোলা নৌকা আমাদের এলাকায় অনেক ছোটবেলায় দেখেছি কখনো কখনো। এ রকম বিশাল হাওর দেখা হয়নি। অনেক দূরে, মাঝেমধ্যে জেগে ওঠা ছোট দ্বীপের মতো কিছু গ্রাম দেখা যায়। পালতোলা নৌকাগুলো বেশির ভাগই মালবাহী। বাঁশ, বালু, পাথর ও ইট নিয়ে যায়। আর কিছু ছোট নৌকা। জেলে নৌকা। মধ্যদুপুরে বরাম হাওরের পানিতে হালকা বাতাসে ঢেউ খেলে পানির ওপর। সূর্যের আলো হেলান দিয়ে এসে পড়ে হাওরের পানির ওপর। তারা ঢেউ খেলে। ঢেউ আর সূর্যকিরণ মিলেমিশে এক চিকমিকি চিকমিকি ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। একসময় আমাদের নৌকা গিয়ে ভেড়ে পীর সাহেবের বাড়ির কাছে। নেমে গিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়ি তাঁর ঘরটিতে।

আমার অনভ্যস্ত ক্যামেরা আর আনাড়ি হাত করিম সাহেবকে কোনো কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই অনুসরণ করতে থাকে।

 

Vatir purush shah abdul karim by Shakur Majid