ভাটির পুরুষ (bhatir purush) পার্ট-২। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের উপরে নির্মিত আমার দেখা সেরা তথ্যচিত্র।

 

সিলেট শহর থেকে ৭৮ কিলোমিটার দূরে দিরাই থানা। থানা সদর থেকে ধলগ্রামে যাওয়ার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। বছরে প্রায় ৮ মাস পানি থাকে এই অঞ্চলে। ভাটি এলাকা। এই ভাটি এলাকায় ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (ফাগুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার) এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন আবদুল করিম। মাত্র ৮ দিন স্কুলে যাওয়ার তাঁর সুযোগ হয়েছিল। গরু রাখালির চাকরি ছিল তাঁর শৈশবের একমাত্র পেশা। কিন্তু গাঁও-গেরামের প্রকৃতি, আকাশ, পানি, পানির মানুষের জীবন, নৌকার চলাচল—এসব কিছু তাঁকে প্রতিদিন শিক্ষা দিতে থাকে। তিনি একতারা হাতে নেন। কিন্তু রক্ষণশীল সমাজ তাঁর এই গান গাওয়া ভালোভাবে গ্রহণ করে না। একসময় ঈদের নামাজের জামাতে তাঁকে ফতোয়া দিয়ে গ্রামছাড়াও করা হয়। তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান, কিন্তু গান ছাড়েন না।

 

 

 

গ্রামের ওস্তাদ করম উদ্দিনের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে চলে যান নেত্রকোনায় বাউল রশিদ উদ্দিনের কাছে। সেখানে তাঁর কাছ থেকে শেখেন দেহতত্ত্বের বিষয়-আশয়। শেখেন শরিয়ত, মারফত, হকিকত আর রিসালাতের কথা। তারপর বেরিয়ে পড়েন গ্রাম থেকে গ্রামে। পালাগান, মালজোড়া গান, জারিগান হয়ে ওঠে তাঁর গানের বিষয়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে কাগমারী সম্মেলনে তাঁর ডাক পড়ে গান গাওয়ার। সেই অনুষ্ঠানে মাওলানা ভাসানী তাঁর গান শুনে আশীর্বাদ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে শ্রেণিসংগ্রাম ও গণমানুষের কথা তাঁর গানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৬৮ সালে সতীর্থ বাউল দুর্বিন শাহকে নিয়ে বিলেতে যান গান গাইতে। আবদুল করিম সিলেট বেতারে নিয়মিত আঞ্চলিক গান গাইতে শুরু করেন ১৯৭৪ সাল থেকে। ঘোষণায় বলা হলো, ‘বাউল আবদুল করিম ও তাঁর দল’। সিলেট বেতার থেকে একসময় তাঁর নাম ঘোষণা হলো ‘শাহ আবদুল করিম’।

২০০৩ সাল থেকেই আমি ও আমার ক্যামেরা অনুসরণ করে এই মানুষটিকে। আগাগোড়াই আমি তাঁকে দেখেছি অত্যন্ত সহজ-সরল ও নির্লোভ একজন অতিথিপরায়ণ মানুষ হিসেবে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে আমি কখনো না খেয়ে আসতে পারিনি। নৌকা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যতক্ষণ নৌকাটি দেখা যেত, ততক্ষণই তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির কিনারা বরাবর সড়কে। শীত, বসন্ত, বর্ষা—তিন ঋতুতেই তাঁর বাড়ি ও তাঁর পারিপার্শ্বিকতা ধারণ করার জন্য আমি তাঁর কাছে গিয়েছি। দেখেছি দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা শাহ আবদুল করিমকে কখনো দাম্ভিক করে তোলেনি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনুরাগীরা তাঁর বাড়িতে তাঁর সন্তানের মতোই বসবাস করতেন। বাড়ির পাশের দুই ব্রাহ্মণ ভাই রণেশ ও রোহী ঠাকুর ছিলেন তাঁর খুব কাছের মানুষ। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না তাঁর অন্তরে। মানুষকে জানা ও মানুষকে ভালোবাসার প্রচারণা করে গেছেন সারা জীবন।

করিমকে নিয়ে আমি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি। নাম ‘ভাটির পুরুষ’। এটা বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল চলতি বছরের পয়লা বৈশাখে। যেদিন তা সম্প্রচারিত হয়, এর পরদিন তাঁর ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর বাবা এটা দেখেছেন কি না। বাউল করিমের ছেলে শাহ নূরজালাল বলেন, ‘বাবা কী দেখবেন, যতক্ষণ তাঁকে দেখানো হয়েছিল, ততক্ষণই তিনি কেঁদেছেন।’ জীবদ্দশায় এই প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসি। তাঁর সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে লিখি স্মৃতিগ্রন্থ ভাটির পুরুষ কথা, ২০১৪ সালে বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে বইটি প্রকাশিত হয়।