স্মৃতিতে শাহ্ আব্দুল করিম

কালনীর তীরে যে রাখাল বালক মাঠের গানে, মাটির টানে নিজেকে সমর্পণ করেন, কালনীর ঢেউ ও বাতাস যাকে একজন সাধক পুরুষে পরিণত করে তিনি বাউলসম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম। সহজ ভাষায় সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে মানুষের হৃদয়ে স্থ্ান করে নেন। তাঁর গানের রাজ্যে তিনি একক অধিপতি। সেই গানের সুরে যুগ যুগ সৌরভ ছড়াবে। লোকসঙ্গিতের যে শাখাতে হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। তিনি রাধারমন, হাসন রাজার যোগ্য অনুসারী। বাংলা ভাষায় তাঁর মত এত জনপ্রিয় সঙ্গিত রচনার বিরল দৃষ্টান্ত কোন বাউল শিল্পীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। রাত জাগা পাখির মত গ্রাম-অঞ্চলে রাতের পর রাত পালাগান গেয়েছেন

Shah Abdul Karim with mustaqim

Shah Abdul Karim with mustaqim(writer)

২০০৭ সালের জুলাই মাসে লন্ডন এসেছিলেন টাওয়ার অব লন্ডন’র পাশে ‘একটি শাহেদ আলী’ অনুষ্ঠানে। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগের রাতে অসুস্থ হয়ে দ্যা রয়েল লন্ডন হস্পিটালে ভর্তি হন। পহেলা জুলাই রবিবার সকালে তাঁর লন্ডনে আগমন ও অসুস্থতার খবর শুনে আমি ও কবি শাহ সোহেল সকাল এগারোটার দিকে সেখানে যাই। সাঈম চৌধুরী ও আমিনা আক্তার আলী সহ কয়েকজনকে পাই তাঁর সার্বক্ষনিক দেখাশুনায়। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার জন্য গলায় একটি মাইনর অপারেশন করে পাইপ লাগানো ছিল। অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলছিলেন। একজন শাহ সোহেল কে দেখে বলে আপনার নাতি এসেছে। তিনি তাৎকনাত মাথা তুলার চেষ্টা করে বলেন নাতি বসো! সে নিজ হাতে তাঁকে কিছু খাওয়াতে সামর্থ হয়। তাঁর কষ্ট হওয়ার সম্ভবনার জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

অপলক দৃষ্টিতে এই ভাটী বাংলার অকৃত্রিম বন্ধুকে মুগ্ধ নয়নে দেখি। হসপিটালে ভিজিটরদের সীমাবদ্ধতার জন্য ঘন্টা খানিকের মধ্যে চলে আসি। এই দেখা-ই ছিল শেষ দেখা। তিনি ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ রোজ শনিবার সকালে পৃথীবির মায়া ছেড়ে তাঁর অন্তরে লালিত মাওলার সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর জীবন গাড়ি চিরদিনের জন্য থেমে যায়। তিনি মানব গাড়ি চড়ে প্রাণনাথের উদ্দেশ্যে চলে যান। স্মৃতির মণিকোটায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি বারবার অনুভব করি। সেই স্মৃতির জানালা খুলে পিছন পানে তাকাই! তাঁর ছবি চোখে ভাসে!

দিন তারিখ মনে নেই ১৯৮৫ সাল। ফেব্র“য়ারী মাস হবে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের বাড়িতে রাতে গান হয়েছে। সিলেট থেকে গায়করা এসেছেন। কিন্তু এসব গান শুনার সুযোগ বা দুঃসাহস কোনটাই ছিলনা। সকালে দেখি পূবের ঘরে কয়েকজন লোক। তাদের পাশে ঢোল তবলা সহ গানের বিভিন্ন সরঞ্জাম। যে কোন ভাবে জানতে পেরেছি তাদের মধ্যে একজন বড় গায়ক আছেন। অন্যান্যরা তার শিষ্য। সেই বড় গায়ক ছিলেন বাউল শাহ্ আব্দুল করিম। আমি দরজা-জানালা দিয়ে বারবার লুকিয়ে তাদের দেখেছি। আমার চাচা শাহ্ মখলিছুর রহমান তাদেরকে বাড়িতে এনেছিলেন। ছোটবেলার সেই দিনের স্মৃতি এখনো ছায়ার মত চোখে লেগে আছে। করিম সাহেব গোসল করেছেন। গায়ে মাখার তেলের জন্য বলেছেন। চাচী বলেছেন কি তেল দেব! তিনি বলেন সরিষার তেল দাও মা! তিনি উদোম গায়ে তেল দেন। আরো কয়েকজন পাশে বসা ছিলেন। আমাদের পূর্ববর্তী গ্রামের এক তরুণও বসে তাদের সাথে হুক্কা টানছিল। তিনি দেখে বলেন, এত অল্প বয়সে এসব করা ঠিক নয়। ভবিষ্যতে ক্ষতি হবে। ঐ দিনের স্মৃতি এর চেয়ে আর বেশি মনে নেই।

যতদিন যায় করিম সাহেবের সাথে আমাদের বাড়ির সম্পর্ক বাড়তে থাকে। আমার চাচা শাহ আমিন উল্লা’র (কবি শাহ সোহেল’র পিতা) সাথে ঘণিষ্ঠতা আরো দৃঢ় হয়। সকাল সন্ধ্যা তিনি আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। অনেক সময় সন্ধ্যা বেলা দেখতাম তিনি গ্রে কালারের ছোট ছোট টাইপ করা একটি কোর্ট গায়ে পড়ে আসতেন। সামনে পড়লে সালাম করতাম নতুবা চেয়ে দেখতাম। কিন্তু কথা বলা বা গান শুনার কোন আগ্রহ ছিল না। বাড়ির সবার মুখে তাঁর গানের জয়গান শুনতাম। আমার আব্বা চাচারা সবাই ভক্ত। বিশেষত শাহ মখলিছুর রহমান মাঝে মাঝে তাঁর গানের বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলতেন। তিনি একদিন আমাকে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, কবি নজরুলের পর বাংলা ভাষায় প্রতিভাবান ব্যক্তি শাহ্ আব্দুল করিম। তাঁরা প্রভূর বিশেষ ভাবে গড়া। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও দেখেছেন। আমার কাছে সেদিনের কথা ততটা গুরুত্ব মনে হয় নি। কিন্তু কালপরিক্রমায় তার কথা যে খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি তা কাউকে আর বুঝাতে হবেনা। চাচাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কতদিন থেকে তাঁকে চেনেন? তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে আসার কয়েক বছর পূর্ব থেকে। কিন্তু এরও অনেক আগে থেকে তাঁর গান শুনেছি।

১৯৯২ সালের এপ্রিল মাস। একদিন চাচা বলেন, আগামী সপ্তাহে টিভি’তে ‘ভরা নদীর বাঁকে’ অনুষ্ঠানে শাহ্ আব্দুল করিম গান গাইবেন। আমরা অনুষ্ঠানের প্রতীক্ষায় থাকি। যথাসময়ে অনুষ্ঠান অধীর আগ্রহে দেখতে শুরু করি। উপস্থাপক মোস্তফা জামান আব্বাসী সিলেট সার্কিট হাউসের সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে তাঁর সাক্ষাত নেন। তিনি বলেন, পরকালেও গান শুনলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। দর্শকদের উদ্দেশ্যে স্বরচিত গান পরিবেশন করেন,

‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল করেরে ময়ূর পঙ্খী নায়…।’

এই প্রথম তাঁর কণ্ঠে গান শুনি। মনে শুনার আরো আগ্রহ জাগে। আমার মনে তিনি নতুন ভাবে আবিস্কৃত হন। ঐ বছর নভেম্বর মাস। বার্ষিক পরীক্ষা সামনে। সন্ধ্যার পরে পড়ায় ব্যস্ত। আব্বার রুমে টিভি চলছে। কয়েকজন বসে আলোচনা করছেন। আমার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আমার বোন ইয়াসমিন এসে বলে পাশের রুমে কে এসেছেন বলতে পারো? আমি একটু বিরক্ত হয়ে বলি কত লোক আসে যায় আমি কি বলব! সে সহজ করে বলে, যিনি এসেছেন তিনি টিভি’তে গান গেয়েছেন। আমি হেসে বলি, শাহ্ আব্দুল করিম । সে বলে, হ্যাঁ। আমি পড়ার টেবিল থেকে গিয়ে দেখি কয়েকজন কথা বলছেন। তিনি আব্বার খাটের উপর বসেছেন। আমাদের ঘরে তাঁকে প্রথম দেখি। আমার দাদী কিছুদিন পূর্বে লন্ডনে মৃত্যু বরণ করেছেন। তিনি পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে এসেছেন। মনে মনে খুব ইচ্ছে জাগে তাঁর মুখে সরাসরি গান শুনব। কিন্তু সময় ও সুযোগ অনুকূলে আসেনি।

১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাস। সিলেট পৌরসভা ধোপাদিঘীর পাড়ে তৎকালীন ওসমানী উদ্যানে তিনদিন ব্যাপী বিজয় মেলার আয়োজন করে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে বাউল গানের আসর অনুষ্ঠিত হত। দ্বিতীয় দিন শাহ্ আব্দুল করিম তাঁর দল সহ উপস্থিত হন। পৌরসভার চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন কামরান বলেন, মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের গৌরব বাউল গানের মুকুটহীন সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম ভাই। আমরা তাঁর রচিত কয়েকটি গান শুনব। তিনি স্রোতাদের সালাম জানিয়ে শুরু করেন তাঁর দেহ তত্ত্বমূলক গান

‘গাড়ি চলেনা চলেনা চলেনারে! গাড়ি চলেনা…’

 

তিনি গানের সাথে সাথে অঙ্গ ভঙ্গিমায় ও স্রোতাদের মুগ্ধ করেন। ডায়নামা বিকল হয়েছে/ হেড লাইট দুইটা জ্বলেনা…’। বলে আঙ্গুল দিয়ে নিজের চোখ যুগল দেখান। এই মঞ্চে তাঁর কয়েকজন শিষ্য ও গান পরিবেশন করেন। তন্মধ্যে প্রয়াত রুহী ঠাকুরের নাম স্মৃতিতে আছে। এই অনুষ্ঠানে প্রথম সরাসরি তাঁর কণ্ঠে স্বরচিত গান শুনি।

১৯৯৭ সালের জুন মাস সিলেটের নবীন প্রবীণ লেখক পাঠকদের জন্য স্মরণীয় মাস। ঐ মাসের ১০-১৪ পাঁচদিন ব্যাপী কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের লেখক পাঠক মুখোমুখি অনুষ্ঠান ছিল। শেষ তিনদিন একজন করে বাংলাদেশর বিখ্যাত লেখকরা উপস্থিত ছিলেন। প্রথম দিন ছিলেন জাফর ইকবাল, দ্বিতীয় দিন ছিলেন হুমায়ূন আহমদ ও তৃতীয় দিন ইমদাদুল হক মিলন। অবশ্যি মিলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন নি। তাঁর মেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায়। হুমায়ূন আহমেদের লেখক পাঠক মুখোমুখি অনুষ্ঠানে তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলেন শাহ্ আব্দুল করিম। আমি কিছুটা বিস্মিত হই! বাংলাদেশের প্রধান লেখক হুমায়ন আহমদের সাথে তাঁর কিসের সম্পর্ক! আমার জানা মতে হুমায়ূন আহমদের নাটকে হাসন রাজার গান আছে। কিন্তু শাহ্ আব্দুল করিমের কোন গান শুনিনি। আমার বিস্ময়ের দরজায় কে যেন করাঘাত করে বলে রতনে রতন চিনে। হুমায়ূন আহমেদের সাথে ফটো তুলে তাঁর সাথে ও ফটো তুলি। আমার এই ফটো তাঁর সাথে জীবনের প্রথম এবং শেষ । মুসলিম সাহিত্য সংসদের মঞ্চ সেই ফটোর ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে আছে।

ঐ বছরের অক্টোবর মাসে আমার বড় চাচা শাহ্ ওয়ারিছ আলী অসুস্থ হয়ে পুরান লেইনস্ত জিন্দাবাজারের তৎকালীন সিটি ক্লিনিকে ছিলেন। একদিন বিকেলে গিয়ে দেখি তাঁকে দেখতে শাহ্ আব্দুল করিম এসেছেন। আমি সালাম করে তাদের কাছে বসি। তিনি চাচার সাথে আলোচনা করছেন। নিরব স্রোতার মত শুনি। চাচা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা গানে ফাতেমা কলছুমার যে কিচ্ছা বলেন তা কতটুকু সত্য? তিনি বলেন, এসব কিচ্ছা যারা গায় তাদের প্রশ্ন করো! আমি কোনদিন বাজে কিচ্ছা লেখিনি ও গাইনি। তাদের আলোচনা কিছুটা বিরতি হলে আমি জিজ্ঞেস করি, হুমায়ূন আহমদের নাটকে কি আপনার গান আছে? তিনি বলেন, নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে আমার লেখা সুর করা পাঁচটি গান বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে রেকর্ড করা হয়েছে। গানের ভিডিও চিত্র তৈরীর ফাঁেক ফাঁকে আমার সাক্ষাতকার গ্রহণ করে ডকুম্যান্টডারী করেছেন । আমি তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করি, আপনাদের গানের কথা (ভাব) বুঝা কঠিন। প্রত্ত্যুতরে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের মাটিও মানুষের কথা লেখি। আমাদের লেখা দেশের আপাময় জনসাধারণ বুঝে। তোমাদের কবি নির্মলেন্দু গুণকে বলেছি, সহজ
ভাষায় কবিতা লেখতে। এসব উচ্চাঙ্গ ভাষায় কবিতা বুঝতে হলে দেশের বেটা-বেটি সবাইকে বি,এ পাস করতে হবে।
শাহ্ আব্দুল করিম’র গান প্রথম সাবলিল ভাসায় ১৯৯৬ সালে সেলিম চৌধুরী তার ‘রূপসাগর’ অডিও ক্যাসেট উপস্থাপন করেন। ঐ ক্যাসেটে তাঁর দুইটি গান ছিল;

(১) সখি কুঞ্জ সাজাওগো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
(২) কেমনে ভূলিব আমি বাঁচিনা তারে ছাড়া আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা…।

১৯৯৭ সালে শিল্পী সুবীর নন্দী, বেবী নাজনীন, দিলরুবা খান, সেলিম চৌধুরী ও তুহিনের যৌথ অডিও ক্যাসেট

‘অন্তরে ভালোবাসা’য়

’আমি কুলহারা কলঙ্কিণী….

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’

গানগুলি বিপুল ভাবে স্রোতাদের কাছে সমাদৃত হয়। এরপর অসংখ্য ক্যাসেটে তাঁর গান ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলেছে। তাঁর গানের মাধ্যমে অনেক গায়ক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। জনপ্রিয় হয়েছে অনেক নাটক। এখন শাহ্ আব্দুল করিমের গান মানে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থান। তিনি বাউল গান ও বাউল শিল্পীদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এখন বাউল গান মানে রাত ভর গ্রাম অঞ্চলে বেসুরা সুরে গান গাওয়া নয়। ড্রয়িং রুমের সিডি প্লেয়ার অন করলে এখন বাউল গান বেজে উঠে

‘মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, না জানি কি করে বন্দে মায়া লাগাইছে….।’

আর এসব সম্ভব হয়েছে তাঁর সহজ সরল যাদুময় ভাষায় মায়াজালে। এখন শিশু যুবক বৃদ্ধ সবাই সেই মায়াজালে বন্ধী হয়ে বলে

‘আইলায় না আইলায় না রে বন্ধু করলায় রে দেওয়ানা….।’

এই জননন্দিত গীতিকার ও শিল্পী ১৯১৬ সালে ১৫ ফেব্র“য়ারী সুনামগঞ্জের দিরাই থানার তাড়ল ইউনিয়নের উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ইব্রাহীম আলী ও নাইওরজান বিবি তাঁর পিতামাতা। তাঁর দাদার ছোট ভাই ফকির নদিব উল্লার কাছে ’ভাবিয়া দেখ মনে মাটির সারিন্দা বাজায় কোন জনে..!’ গানটি শুনে শুনে গানের প্রতি আকৃষ্ঠ হন। নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র আটদিন বর্ণ শিক্ষা-ই সম্বল। দারিদ্রতার কারণে রাখালের কাজ করতেন। মাঠে ঘাটে হাওরে গরু চরাতেন। তিনি বলেন, ’গরু নিয়ে প্রতিদিন হাওরে যাই, ঈদ শুভদিনেও আমার ছুটি নাই..’। কোন কিছুই তাঁর সঙ্গিত সাধনা দমাতে পারেনি। বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের গুরু ছিলেন কামাল উদ্দিন, শাহ্ ইব্রাহিম মস্তান বক্স ও নেত্রকোনার বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন। মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, মরমি, গণসঙ্গীত, আঞ্চলিক ইত্যাদি গান রচনা করেছেন। দেড় হাজারের বেশি গান লিখেছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে

আফতাব সঙ্গিত (১৯৪৮),

গণ সঙ্গিত (১৯৫৭),

কালনীর ঢেউ (১৯৮১),

ধলমেলা (১৯৯০),

ভাটির চিঠি(১৯৯৮),

কালনীর কুলে (২০০১) ইত্যাদি।

নিজের শেষ সম্বল নয় কেদার জমি বিক্রি করে ১৯৮১ সালে ’কালনীর ঢেউ’ প্রকাশ করেন।

তিনি লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্ ও দুদ্দু শাহের দর্শনে অনুপ্রানিত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে গণসঙ্গিত পরিবেশন করে মাওলানা ভাসানী, হোসেন সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন। বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জের এক জনসভায় তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে ৫০০ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন।
গত তিন দশক থেকে লোকসঙ্গিতের এক বিশাল অংশ তাঁর দখলে ছিল। একে একে রচনা করেছেন কালজয়ী সঙ্গিত। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর দশটি গান ইংরেজীতে অনুদিত হয়েছে।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে মুসলিম সাহিত্য সংসদে তাঁর কণ্ঠে সর্বশেষ গান শুনি। ঐদিন রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। দর্শকদের অনুরোধে গান পরিবেশন করেন। পিছন থেকে একজন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন। আর তাঁর দর্শন ও গান শুনার সুযোগ হবেনা। বাউল গান তাঁর হাত ধরে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।

২০০১ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।

২০০২ সালে প্রকাশিত হয় আইডিয়া স্মারক।

২০০৩ সালে লাভ করেন লেবাক এওর্য়াড।

২০০৪ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা।

২০০৫ সালে সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক এওয়ার্ড আজীবন সম্মাননা লাভ করেন।

২০০৬ আর্ন্তজাতিক প্রবীণ দিবসে সালে তাঁকে জাতিসংঘ সম্মাননা প্রদান করা হয়।

একই বছর সিলেট সিটি কর্পোরেশন সম্মাননা লাভ করেন।

২০০৮ সালে শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননা এবং খান বাহাদুর এহিয়া এস্টেট সম্মাননায় ভূষিত হন।

২০০৯ সালে ২২শে মে সর্বস্তরের সিলেটবাসী তাঁকে সংবর্ধনা জানান।

ঐদিন তাঁর রচনা সমগ্র প্রকাশিত হয়। তিনি এভাবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। দেশে-বিদেশে ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। অবশেষে তিনি সবকিছু ছেড়ে তাঁর দরদীয়া বন্ধুর কাছে চলে যান।

যেভাবে তিনি বলেছেন,

দরদীয়া রে বন্ধু দরদীয়া রে,
আমি তোরে চাইরে বন্ধু
আমার আর দরদী নাইরে…।

তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে যুগ যুগ আমাদের স্মৃতিতে-প্রীতিতে সব সময় বিচরণ করবেন। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করি!

 

ফয়জুল আলম বেলাল

original post link : http://www.somewhereinblog.net/blog/mustaqim/29074855